Friday, February 10, 2023

 Ancient History:

আল-আকসা মসজিদ


আল-আকসা মসজিদ:

                                    মসজিদুল আকসা বা বাইতুল মুকাদ্দাস নামেও পরিচিত) জেরুসালেমের পুরনো শহরে অবস্থিত ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ এটির সাথে একই প্রাঙ্গণে কুব্বাত আস সাখরাকুব্বাত আস সিলসিলা ও কুব্বাত আন নবী নামক স্থাপনাগুলো অবস্থিত। স্থাপনাগুলো সহ এই পুরো স্থানটিকে হারাম আল শরিফ বলা হয়। এছাড়াও স্থানটি "টেম্পল মাউন্ট" বলে পরিচত এবং ইহুদি ধর্মে পবিত্র বলে বিবেচিত হয়। ইসলামের বর্ণনা অনুযায়ী মুহাম্মদ (সা) মিরাজের রাতে মসজিদুল হারাম থেকে আল-আকসা মসজিদে এসেছিলেন এবং এখান থেকে তিনি ঊর্ধ্বাকাশের দিকে যাত্রা করেন। ইতিহাসবিদ পণ্ডিত ইবনে তাহমিয়ার মতে, আসলে সুলায়মান (আঃ) এর তৈরি সম্পূর্ণ উপাসনার স্থানটির নামই হল মসজিদুল আল-আকসা।সহীহ আল বোখারীর আবু যর গিফারী ব‌র্ণিত হাদীস থে‌কে জানা যায় এ‌টি সর্ব প্রথম আদম(আলাইহিস সালাম) তৈরি করেছিলেন এবং এ‌টি ছিল পৃ‌থিবীর দ্বিতীয় মস‌জিদ। রাসূল (সাঃ‌)কে হা‌দি‌সে জি‌জ্ঞেস করা হ‌য়ে‌ছে এ‌টি বায়তুল্লাহ নির্মা‌ণের কত দিন পর নির্মাণ করা হ‌য়ে‌ছিল? তি‌নি ব‌লে‌ন,চ‌ল্লিশ বছর পর। মুসলমানরা বিশ্বাস করে, নির্মাণের পর থেকে এটি ঈসা (আঃ) সহ অনেক নবীর দ্বারা এক আল্লাহকে উপাসনার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। এই স্থান মুসলিমদের প্রথম কিবলা (প্রার্থনার দিক) হিজরতের পর কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণে কাবা নতুন কিবলা হয়। বর্তমানে "আল-আকসা" মসজিদ বলতে বোঝাায় কিবলি মসজিদ, মারওয়ানি মসজিদ ও বুরাক মসজিদ (৩টির) এর সমন্বয় যা "হারাম আল শরীফ" এর চার দেয়াল এর মধ্যেই অবস্থিত।
 খলিফা উমর (রাঃ) বর্তমান মসজিদের স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিকের যুগে মসজিদটি পুনর্নির্মিত ও সম্প্রসারিত হয়। এই সংস্কার ৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে তার পুত্র খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদের শাসনামলে শেষ হয়। ৭৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর এটি পুনর্নির্মাণ করেন। পরে তার উত্তরসুরি আল মাহদি এর পুনর্নির্মাণ করেন। ১০৩৩ খ্রিষ্টাব্দে আরেকটি ভূমিকম্পে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফাতেমীয় খলিফা আলি আজ-জাহির পুনরায় মসজিদটি নির্মাণ করেন যা বর্তমান অবধি টিকে রয়েছে।

বিভিন্ন শাসকের সময় মসজিদটিতে অতিরিক্ত অংশ যোগ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে গম্বুজ, আঙ্গিনা, মিম্বর, মিহরাব, অভ্যন্তরীণ কাঠামো। ১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ক্রুসেডাররা জেরুসালেম দখল করার পর তারা মসজিদটিকে একটি প্রাসাদ এবং একই প্রাঙ্গণে অবস্থিত কুব্বাত আস সাখরাকে গির্জা হিসেবে ব্যবহার করত। সুলতান সালাহউদ্দিন জেরুসালেম পুনরায় জয় করার পর মসজিদ হিসেবে এর ব্যবহার পুনরায় শুরু হয়। আইয়ুবী, মামলুক, উসমানীয়, সুপ্রিম মুসলিম কাউন্সিল ও জর্ডানের তত্ত্বাবধানে এর নানাবিধ সংস্কার করা হয়। বর্তমানে পুরনো শহর ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তবে মসজিদটি জর্ডা‌নি/ফিলিস্তিনি নেতৃত্বাধীন ইসলামি ওয়াকফের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।


নাম উৎপত্তি:

                      মসজিদুল আকসা অর্থ "দূরবর্তী মসজিদ"।  মিরাজের রাতে মুহাম্মদ (সা) বোরাকে চড়ে মক্কা থেকে এখানে এসেছিলেন মর্মে কুরআনে উল্লেখ রয়েছে। অনেক বছর ধরে মসজিদুল আকসা বলতে পুরো এলাকাকে বোঝানো হত এবং মসজিদকে আল-জামি আল-আকসা  বলা হত।


আধুনিক যুগ:

                        ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে বিশ শতকের প্রথম সংস্কার সাধিত হয়। এসময় জেরুসালেমের গ্র্যান্ড মুফতি মুহাম্মদ আমিন আল-হুসাইনির অধীন সুপ্রিম মুসলিম কাউন্সিল তুর্কি স্থপতি মিমার কামালউদ্দিন বেকে মসজিদুল আকসা ও এর পরিপার্শ্বের স্থাপনাগুলো সংস্কারের জন্য দায়িত্ব দেয়। এছাড়াও কাউন্সিল ব্রিটিশ স্থপতি, মিশরীয় প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ এবং স্থানীয় কর্মকর্তাদের সংস্কারে অবদান ও তদারকির দায়িত্ব দিয়েছিল। এই সংস্কারের মধ্যে ছিল মসজিদের প্রাচীন উমাইয়া ভিত্তি মজবুত করা, ভেতরের কলাম মজবুত করা, নতুন বীম যুক্তকরণ, একটি মঞ্চ নির্মাণ, আর্চ এবং মূল গম্বুজের ভেতরের অংশ সংরক্ষণ, দক্ষিণ দেয়াল পুনর্নির্মাণ এবং কেন্দ্রীয় সারির কাঠগুলো কংক্রিটের স্ল্যাব দ্বারা প্রতিস্থাপন। এসময় প্লাস্টারে ঢাকা পড়ে যাওয়া ফাতেমীয় আমলের মোজাইক ও খোদিত লিপি ফিরিয়ে আনা হয়। আর্চগুলো স্বর্ণ এবং সবুজ ছোপযুক্ত জিপসাম দ্বারা সৌন্দর্যমন্ডিত করা হয় এবং কাঠের বীমগুলো পিতল দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়। কিছু স্টেইন্ড গ্লাসের জানালা তাদের আব্বাসীয় ও ফাতেমীয় নকশা অপরিবর্তিত রেখে নতুন করা হয়। ১৯২৭ ও ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ভূমিকম্পে মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তবে ১৯৩৮ ও ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে তা সারিয়ে তোলা হয়।
             ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২১ আগস্ট অস্ট্রেলীয় পর্যটক ডেনিস মাইকেল রোহান কর্তৃক মসজিদে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। রোহান ওয়ার্ল্ডওয়াইড চার্চ অফ গড নামক এভাঞ্জেলিকাল খ্রিষ্টান গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন। তার ধারণা ছিল যে মসজিদুল আকসা পুড়িয়ে ফেলার মাধ্যমে তিনি যীশুর দ্বিতীয় আগমনকে ত্বরান্বিত করতে পারবেন এবং ইহুদি মন্দির তৈরীর পথ করতে পারবেন। রোহানকে এরপর একটি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সেই বছর রাবাতে মুসলিম দেশগুলোর এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সৌদি আরবের তৎকালীন বাদশাহ ফাহাদ বিন আবদুল আজিজ এর উদ্যোক্তা ছিলেন। এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ওআইসি গঠনের ক্ষেত্রে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে।
          
           ১৯৮০ এর দশকে গুশ এমুনিম আন্ডারগ্রাউন্ড নামক সংগঠনের সদস্য বেন শোশান ও ইয়েহুদা এতজায়ন আল-আকসা মসজিদ ও কুব্বাত আস সাখরা উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেন। এতজায়ন বিশ্বাস করতেন যে স্থাপনা দুটি উড়িয়ে দিলে তা ইসরায়েলের আধ্যাত্বিক জাগরনে ভূমিকা রাখবে এবং ইহুদি জনগণের সকল সমস্যা সমাধান করবে। তারা এও ধারণা করতেন যে তৃতীয় মন্দির মসজিদের স্থানে নির্মিত হতে হবে। প্রথম ইন্তিফাদা চলার সময় ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জানুয়ারি ইসরায়েলি সেনারা মসজিদের বাইরে বিক্ষোভকারীদের উপর রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস ছোড়ে এবং এতে ৪০ জন মুসল্লি আহত হয়। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের ৮ অক্টোবর দাঙ্গায় ইসরায়েলি সীমান্ত পুলিশ কর্তৃক ২২ জন ফিলিস্তিনি নিহত ও ১০০ জনের বেশি আহত হয়। টেম্পল মাউন্ট ফেইথফুল নামক ইহুদি ধর্মীয় গোষ্ঠী তৃতীয় মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করতে যাচ্ছে ঘোষণা করলে এই প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল।

          ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলের তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা এরিয়েল শ্যারন এবং লিকুদ পার্টির সদসরা ১০০০ সশস্ত্র রক্ষীসহ আল-আকসা চত্বর পরিদর্শন করেন। ব্যাপক সংখ্যক ফিলিস্তিনি এর প্রতিবাদ করে। শ্যারন ও লিকুদ পার্টির সদস্যরা স্থানত্যাগ করার পর হারাম আল শরিফের প্রাঙ্গণে ইসরায়েলি দাঙ্গা পুলিশের উপর পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে বিক্ষোভ শুরু হয়। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও রাবার ছুড়লে ২৪ জন আহত হয়। এই পরিদর্শনের ফলে পাঁচ বছরব্যপী আন্দোলন চলে সাধারণভাবে আল-আকসা ইন্তিফাদা নামে পরিচিত। তবে কিছু ধারাভাষ্যকার ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা, যেমন ইমাদ ফালুজি ও আরাফাতের উদ্ধৃতি দিয়ে দাবি করেন যে ইন্তিফাদা কয়েক মাস আগে ইয়াসির আরাফাতের ক্যাম্প ডেভিড আলোচনা থেকে ফেরার পর থেকে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ২৯ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলি সরকার মসজিদে ২,০০০ দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করে। জুমার নামাজের পর একদল ফিলিস্তিনি মসজিদ ত্যাগ করার পর তারা পুলিশের উপর পাথর নিক্ষেপ করে। পুলিশ এরপর মসজিদ চত্বরে প্রবেশ করে গুলি ও রাবার বুলেট ছোড়া শুরু করে ফলে চারজন নিহত ও প্রায় ২০০ জন আহত হয়।

২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর ইসরায়েলি পুলিশ ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে জেরুসালেম দখল করার পর প্রথমবার আল-আকসায় প্রবেশ করে বলে ইসলামিক ওয়াকফের পরিচালক শাইখ আজ্জাম আল-খতিব উল্লেখ করেছেন। পূর্ববর্তী মিডিয়া রিপোর্টে বলা হয় এ পুলিশ হারাম আল শরিফ চত্বরে প্রবেশ করেছে, মসজিদে নয়।

ইসলামে ধর্মীয় গুরুত্ব:


                   ইসলামে আল-আকসা মসজিদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা বিশ্বাস করে যে ,এটি পৃথিবীতে নির্মিত দ্বিতীয় মসজিদ যা মসজিদুল হারামের পরে নির্মিত হয়। কুরআনে মিরাজের ঘটনা উল্লেখ করার সময় এই স্থানের নাম নেয়া হয়েছে।রাশিদুন খিলাফত এর পরেও ইসলামি পণ্ডিতরা একে ঐতিহ্যগতভাবে "আল-ইসরা " বলে উল্লেখ করত (যেহেতু সূরা বনী ইসরাঈল (রাত্রির যাত্রা) এ এটিকে উল্লেখ করা হয়েছে) । এই সুনির্দিষ্ট আয়াতটি  ইসলামে "আল-আকসা" এর গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছে । এই আয়াতটিতে বলা হয়েছে " পবিত্র ও মহিমময় তিনি  যিনি তাঁর বান্দাকে রাতারাতি  ভ্রমণ করিয়েছেন (মক্কার) মাসজিদুল হারাম হতে (ফিলিস্তীনের) মাসজিদুল আকসায় "। এই আয়াতটির অনুবাদ ও ব্যাখ্যায় প্রায় সব পণ্ডিতই সুনির্দিষ্টভাবে "আল-আকসা" ও "মসজিদ আল-হারাম" উল্লেখ করেছেন  এবং বর্ণিত "আল- আকসা" টি যে "জেরুসালেমে " অবস্থিত "আল-আকসা" টিই তা নিশ্চিত করেছেন (ড. মুজিবুর রহমান ,মহসিন খান,আব্দুল হামিদ ফাইজী ও অধ্যাপক মোজাম্মেল হকের বঙ্গানুবাদেও তাই )

আরবি (  إِسْراءٌ ) শব্দের অর্থ হল , "রাতে নিয়ে যাওয়া "। পরে ( لَيْلًا ) শব্দটি উল্লেখ করে রাতের অল্প একটি সময়ের কথা বোঝানো হয়েছে যার জন্য  ( لَيْلًا ) (অনির্দিষ্ট) ব্যবহার করা হয়েছে (রাতের এক অংশে অথবা সামান্য অংশে )। দূরত্বকে বলা হয় ( أَقْصَى)। ‘আল-বাইতুল মুকাদ্দাস’ বা ‘বাইতুল মাকদিস’ ফিলিস্তীন এর কদস অথবা জেরুসালেম বা (পুরাতন নাম) ঈলীয়া শহরে অবস্থিত।  এবং সে সময়ের বাহনে মক্কা থেকে ক্বুদ্‌স শহরে যেতে ৪০ দিন লাগত সেকারণে  ‘মাসজিদুল আকসা’ (দূরতম মসজিদ) বলা হয়েছে। মুফাসসিরগন এই  আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে , এটি ছিল বনি ইসরাইলের দাওয়াত ও তাবলিগের জায়গা এবং নামাযের কেবলা, যা মুসলমানদের কাছেও সম্মানিত ও পবিত্র ।

অন্যান্য মুসলমান পণ্ডিতরা হারাম আস শরীফ এর কার্যক্রম বিস্তারিত জানার জন্য তোরাহ্ (আরবিতে তাওরাত বলা হয় ) ব্যবহার করেছিলেন।

Collected